গর্ভবর্তী মায়ের খাদ্য ও পুষ্টির ওপর কেবল তাঁর স্বাস্থ্যই নির্ভর করে না, মায়ের গর্ভে শিশুর বেড়ে ওঠার ধারাও এর ওপর নির্ভরশীল। তাই মায়ের দেহের পুষ্টির সরবরাহ ঠিক রাখতে খাদ্যাভ্যাস বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি।

সুষম খাবার গ্রহন করুন:

food-to-eat-pregnancy

স্বাভাবিক সুস্থ জীবনের জন্য প্রত্যেকেরই সুষম খাবার গ্রহন করা প্রয়োজন। গর্ভবর্তী মায়ের এ সুষম খাবার কতটা প্রয়োজন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুষম খাদ্য গ্রহণের সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে আপনার খাবারের তালিকায় পাঁচমিশালী খাদ্যের সংমিশ্রণ। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও ডাল জাতীয় খাদ্য দেহের প্রয়োজনীয় গঠনের রক্ষণাবেক্ষণের উপাদান প্রোটিন সরবরাহ করে। ভাত, আলু, রুটি, মিষ্টি ইত্যাদি শর্করা জাতীয় উপাদান দেহে কর্মশক্তি যোগান দেয়। আর টাটকা ফল, সবুজ ও হলুদ শাক সবজি নানারকম ভিটামিন ও খনিজ লবণের উৎস বলে প্রতিদিন এগুলো কিছু পরিমাণ হলেও খেতে হবে। এ ছাড়া পানি তো আছেই।

আপনার খাদ্যাভ্যাসকে পরিমিত করুন:

পরিমিত খাদ্যাভ্যাস মানে কম বা বেশি খাওয়া নয়, বরং যথাযথ পরিমাণে খাওয়া। তবে সুষম খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনার খাদ্যাভ্যাস কেমন হবে তা নিজেই পর্যালোচনা করুন। যদি মনে করেন, আপনি সাধারণত কম খেয়ে থাকেন, তবে বেশি পুষ্টিকর খাবার অভ্যাস করুন, কারণ এর মাধ্যমে আপনি আপনার অনাগত সন্তানকে সবচেয়ে ভাল উপহার দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

যদি এমন হয় আপনার ওজন এমনিতেই একটু বেশি, তবে প্রথম ট্রিমেস্টারে (০-১৩ সপ্তাহ) আপনার হয়তো অতিরিক্ত ক্যালরি দরকার হবে না। তবে দ্বিতীয় ট্রিমেস্টারে (১৪-২৬ সপ্তাহ) দৈনিক ৩০০ ক্যালরি, এবং তৃতীয় ট্রিমেস্টারে (২৭-৪০ সপ্তাহ) দৈনিক ৪৫০ ক্যালরি সমপরিমান খাবার আপনাকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। আপনার ওজন বর্তমানে কেমন তার উপর ভিত্তি করে গর্ভধারনের ট্রিমেস্টার গুলোর জন্য শুরুতেই একটি ওজন-লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করুন।

যেসব খাবার এড়িয়ে চবে:

food-to-avoid-during-pregnancy-2সকল ধরনের সামুদ্রিক মাছ, কাকড়া, অপাস্তুরিত দুধ, অপাস্তুরিত দুধ থেকে বানানো দধি, কাঁচা বা অর্ধসিদ্ধ- সবজি, পাতা, শাক ও মাংস থেকে দুরে থাকুন। এধরনের খাবার গুলো ব্যকটেরিয়ার আকর, যা আপনার অনাগত সন্তানের ক্ষতির কারণ হতে পারে। এধরনের কাঁচা খাবার থেকে লিস্টেরিওসিস নামের ব্যকটেরিয়াবাহী রোগে আক্রান্ত হতে পারেন আপনি, যেটা বিশেষত গর্ভাবস্থায় বেশ ঝুঁকির কারণ হতে পারে।

প্রায় সব সামুদ্রিক মাছে মিথিল মার্কারি নামের একটি ধাতুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যার উচ্চমাত্রা গর্ভস্থ শিশু ও বাচ্চাদের মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর। তাই, আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন প্রতি সপ্তাহে বড়জোর ১২ আউন্স মাছ খাওয়ার পরামর্শ দেয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, কফি ছাড়াও চা, কোমল পানীয়, কোকো, চকোলেট এ ক্যাফেইন থাকে। তাই ক্যফেইনবিহীন খাদ্য ও পানীয় বেছে নিন। অথবা, আরো ভালো হয়, যদি আপনি ক্যাফেইনের সমৃদ্ধ খাবারের বদলে স্বাস্থ্যকর খাবার যেমন: ননীতোলা দুধ, ১০০% ফলের জুস, লেবু সরবত গ্রহণ করেন। সকালের কফির পরিবর্তে একমগ গরম দুধ হতে পারে ভাল বিকল্প।

যদি আপনার মদ্যপানের অভ্যাস থাকে, যেটা আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশ বিরল, তবে এসময় তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কারণ মদ্যপান আপনার শিশুর শারীরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এছাড়াও মদ্যপান আপনার শিশুর দীর্ঘমেয়াদী শেখার ক্ষমতা, আবেগ প্রবণতা এসবে বেশ প্রভাব ফেলে। তাই গর্ভবস্থায় সম্পূর্ণ রুপে মদ পরিহার করা জরুরী।

অতিরিক্ত ভিটামিন-খনিজ গ্রহণ:

আদর্শ অবস্থায়, যখন আপনার কোন বমিভাব বা খাদ্য অনীহা নেই, তখন একজন মায়ের জন্য দরকারী পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ সুষম খাবার তো থাকবেই। একইসঙ্গে সন্তান সম্ভবা মা’কে অতিরিক্ত ভিটামিন ও খনিজ গ্রহণ করতে হয়, যা তার ও তার সন্তানের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করে।

আপনার ভিটামিনে অবশ্যই যেন ফলিক এসিড থাকে। কারণ গর্ভাবস্থায় দৈনিক ৪০০ মিগ্রা: এবং শুরুর দিকে দৈনিক ৬০০ মিগ্রা: ফলিক এসিড দরকার হয়। ফলিক এসিডের অভাবে আপনার সন্তান মেরুদন্ডে সমস্যা নিয়ে জন্ম নিতে পারে।

গর্ভাবস্থার মাঝামাঝি থেকে আপনার আয়রন অথবা ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার দরকার হতে পারে। এছাড়া অনেক বিশেষজ্ঞ পুরো গর্ভাবস্থায় ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট নেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

যেসব মায়ের স্বাস্থ সমস্যা যেমন ডায়াবেটিস, গর্ভধারণকালীন ডায়াবেটিস, রক্তস্বল্পতা আছে এবং যারা আগে স্বল্প ওজনের বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন, তাদের কোন ধরনের ভিটামিন নেয়া দরকার তা নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলার দরকার হয়। তবে এসব ভিটামিন বা সাপ্লিমেন্ট নেয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, পুষ্টিগুনের জন্য প্রাকৃতিক উৎসের বিকল্প নেই এবং অধিক ভিটামিন মানেই স্বাস্থ্যবান শিশু না।1

ডায়েট কন্ট্রোল নয়:

গর্ভধারণের সময় ডায়েট কন্ট্রোল করা মা-সন্তান উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।  কারণ ডায়েট কন্ট্রোলের ফলে কেবল ক্যালরিই কমছে না একইসঙ্গে আয়রন ফলিক এসিড ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ এবং পানিও কমে যায়। অথচ গর্ভধারণের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো বাড়তি ওজন লাভ। যেসব মায়েরা ভালো খান এবং প্রয়োজনীয় ওজন লাভ করেন তাদের সুস্থ্য-সবল সন্তান লাভের সম্ভাবনা বেশি। ফলে আপনি যদি ফ্রেশ ও স্বাস্থ্যকর খাবার খান এতে আপনার ওজন বাড়লেও চিন্তার কারণ নেই; আসলে আপনি তো দুইজনের খাবার খাচ্ছেন!

 বারবার খান, কম হলেও:

গর্ভাবস্থায় আপনার বমি বমি ভাব, খাবারে অরুচি কিংবা বদহজম হলে একবারে বেশি খেতে না পারলে কম হলেও বিভিন্ন খাবার দিন পাচ-ছয়বার খেতে পারেন। তবে এসময় লক্ষ্য রাখতে হবে খাবার যাতে সুষম ও ক্যালরি সমৃদ্ধ হয়। তবে এক্ষেত্রে জাঙ্ক ফুড যত এড়ানো যায় ততই ভালো।

আমাদের অনেকের মাঝে গর্ভবর্তী মায়েদের খাবারের বিষয়ে কিছু কুসংস্কার রয়েছে। যেমন- মৃগেল মাছ খেলে সন্তানের মৃগী রোগ হয় কিংবা শাক-সবজি খেলে বদহজম হবে ইত্যাদি। এসব মেনে যারা বাছাই করে কম খাবার খান তারা কেবল নিজেরই ক্ষতি করছেন না, সন্তানের কম ওজন আর অপুষ্টি নিয়ে জন্মাতেও ভুমিকা রাখছেন!

লেখাটি রিভিউ করেছেন –

ডাঃ সাবরিনা আফরোজ
MBBS, MPH
লেকচারার, ঢাকা কমিউনিটি মেডিসিন কলেজ

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা